Thursday, December 22, 2016

এক মহিয়সী নারী "আমিনা কুতুব" তাঁর সংগ্রামী জীবন এর অবিষ্মরনীয় এক গল্প



আমার এই চিঠিটা অশ্রুভেজা বলে যদি না পড়তে পারো, আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো --আমিনা কুতুব

মিশরের ইখওয়ানুল মুসলিমীন (মুসলিম ব্রাদারহুড) এর প্রতিষ্ঠাতা সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ এর বোন ছিলেন অামিনা। বিশ বছর বয়সে আমিনা বিয়ে করেন কামাল আস-সানানিরী নামক এক মুজাহিদকে।

কামাল ছিলেন মিসরের ইখওয়ানুল মুসলিমীনের প্রথম সারির একজন নেতা। তার জ্ঞান গরিমা, শিক্ষা দীক্ষা ও আল্লাহর উপর আস্থা ছিল ঈর্ষণীয়। ইখওয়ানের বলিষ্ঠ নেতা হওয়ার অপরাধে জামাল আব্দুল নাসেরের সামরিক সরকার ১৯৫৪ সনে তাকে ফাঁসির নির্দেশ দেয়। পরে অবশ্য সমালোচনার মুখে বা অন্য কোন চাপে নতি স্বীকার করে এই নির্দেশ প্রত্যাহার করে নিলেও তাকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করে। পাঁচ বছর কারাগারের অত্যাচারে তার দেহ ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায়, ফলে এক মানবিক আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকার তাকে কারা হসপিটাল 'লিমান তুররা' থেকে চিকিৎসা গ্রহনের দূর্লভ সুযোগ করে দেয়। চিকিৎসা গ্রহনের সময় ঘটনাক্রমে সাইয়েদ কুতুবের সাথে একই কেবিনে থাকার সুযোগ পান তিনি।

এই সময় একদিন কামাল আমিনা কুতুবকে ভাইয়ের সাথে কথা বলতে দেখতে পান। তার কথা বার্তায় ও স্বভাব চরিত্রে বিমোহিত হন কামাল। অনেক ভেবে চিনতে, ইস্তেখারা করে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে সাইয়্যেদের কাছে আমিনার সাথে বিয়ের প্রস্তাব দেন তিনি। কামালের যোগ্যতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিলনা বড়ভাই সাইয়্যেদের। তারপরও এই প্রস্তাব তিনি আদরের ছোট বোনের কাছে উপস্থাপন করেন এবং এ নিয়ে ইস্তেখারা করার পরামর্শ দেন। টানা কয়েক দিন ইস্তেখারা করার পর আমিনা তার মা এবং ভাই বোনদেরকে এই অদ্ভুত বিয়েতে তার অনাপত্তির কথা জানিয়ে দেন। সবাই জানত যাবজ্জীবন কারাদন্ড মানে পঁচিশ বছর কারাবাস। কিন্তু ইস্তেখারায় যেহেতু তিনি ইতিবাচক ইংগিত পেয়েছেন, তাই এই কারাগারের প্রকোষ্ঠে থাকা মুজাহিদ কামালকে স্বামী হিসাবে গ্রহন করতে দ্বিধা করলেন না। বিয়ের পর অপেক্ষা করতে থাকেলেন বিশটি বছর পার হয়ে, কবে দেখা হবে প্রেয়সী স্বামীর সাথে। বিরহের এই সময় যদিও ছিল আমিনার জীবনে খুবই দুঃসহ দিন, কিন্তু দাওয়াতী যিন্দেগীর সাথে দ্বিগুন তৎপরতার মাধ্যমে সে ব্যাথা উপশম করার প্রয়াস পেতেন। বেদনার দগ্ধ ক্ষতে হাত বুলাতে ধীরে ধীরে আসতে শুরু হল সুরের উর্বশীরা। দেখা দিতে শুরু করলো, সেই সুরের মূর্ছনা ফুটে উঠলো তার লেখা কবিতা ও গীতিকাব্যের অন্তঃসলিল প্রবাহে।

কলম ধরলেন আমিনা। লিখতে থাকলেন অনিরূদ্ধ কবিতা আর সুন্দর সুন্দর ছোট গল্প। স্বামী ও বড় ভায়ের সাথে দেখা করতে যেতেন তিনি প্রতি সপ্তাহে, আর ফিরে আসতেন বুকভাঙ্গা ব্যাথা নিয়ে। তার ঐসব ব্যাথা পঙ্কতি হয়ে বেরিয়ে জমা হতে থাকত কায়রোর নাম করা 'আদাব' 'আদীব' এবং 'আলাম আলআরাবি' ইত্যাদি পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে।

এক অনির্বচণীয় সিদ্ধান্ত
-------------------------------
সামরিক জান্তা ইখওয়ানের নেতা কর্মিদের ওপর অত্যাচারের স্টীম রোলার চালানোর জন্য তাদেরকে মিসরের 'ক্বানা' কারাগারে স্থানান্তর করে। কায়রো থেকে অনেক দূরে ছিল এই কারাগার। একবার আমিনা তার ননদ কে নিয়ে স্বামী কামালের সাথে দেখা করতে যান। কথা বলার এক ফাঁকে ননদ তার ভাইকে দূরের এই কারাগারে আসতে তাদের দূর্ভোগের বর্ণনা করেন। কামাল শুনে খুব ব্যাথা পেলেন। আমিনাকে একান্তে কাছে নিয়ে বললেন- "আমিনা! অনেক দিন হয়ে যাচ্ছে, ছাড়া পাচ্ছিনা, আর কবে যে ছাড়া পাব তারও কোন ঠিক ঠিকানা নেই। আমাদের বিয়ের সময় তোমাকে বলেছিলাম, এই তো কয়টা দিন, আমরা একত্রে থাকতে পারব আর ক’দিন পরেই। কিন্তু এখনো বিশ বছর আমাদের দেরী করতে হবে। আমিনা! আমার মনে হয়, তোমাকে এত কষ্ট দেয়া ঠিক হবেনা। কারাগারের এই কঠিন প্রকোষ্ঠে আমার শেষ নিঃশ্বাসও ফেলতে হতে পারে। তাই আমি বলি কি, তুমি জীবন পথে তোমার সাথে চলতে পারে এমন কাওকে স্বামী হিসাবে গ্রহন কর......... তোমার বিরহ যাতনা দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে............ তোমার সুখের কথা ভেবে আমার মনে হচ্ছে তোমার পথ তুমি বেছে নাও। আমিনা! স্বৈরাচার জামাল আমাদের সাথে আলোচনা করেছে, বলেছে আমরা যদি তাকে সাহায্য প্রতিশ্রুতি দেই, তবে আমাদের মুক্তি দেবে। আমাদের প্রাপ্য সম্মান বুঝিয়ে দেবে। আমি বলে দিয়েছি, আল্লাহ্ চাইলে তোমরা আমার সারা শরীর কেটে টুকরা টুকরা করে ফেলতে পার, কিন্তু ওই রকম আশ্বাস আমার কাছে তোমরা পাবেনা। আমিনা, এখন ভেবে দেখ, আমি তোমাকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করে দিচ্ছি......... তুমি ভেবে দেখ।"

আমিনা কথা শুরু করার সাথে সাথে কারার লৌহ কপাট বন্ধ করে দেয়া হয়। আমিনা বাড়ি ফিরে স্বামীকে তার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে কবিতার ভাষায় এক লম্বা চিঠি লেখেন। আরবি সাহিত্যের ইতিহাসে অমন রোমান্টিক চিঠি খুবই বিরল। চিঠির শেষ পংক্তি টি এমন- "নিরন্তর পথ চেয়ে বসে আছি, শুধু তোমার জন্য। না হয় সে পথ হোক জিহাদের। লাল পথ ধরে পায়ে পায়ে যাই চল জান্নাতের দ্বারে। জান যায় যাক, সেই ওয়াদার খাতিরে ভয় কি? লজ্জা কি? কিসের বা বেদনা আমার?

দুদিনের সংসার
-------------------------------
দীর্ঘ বিশ বছর কারা ভোগ করে কামাল মুক্তি পান ১৯৭৩ সনে। সেতো আর মুক্তি ছিলনা, ছিল ধুলার ধরায় স্বর্গ রচনার নির্মল প্রয়াস। আমিনা ও কামাল জুটি লাভ করে জীবনের সব চেয়ে আনন্দের ক্ষন। সংসার পাতেন তাঁরা। কিন্তু তাঁদের সংসার বলতে কি আর অন্যদের মত হয়? এই বিমল আনন্দের মাঝেও তাদের আসল দ্বায়িত্ব ভুলেননি তারা। দুইজনই তো ইসলামি আন্দোলনের সংগ্রামি মিছিলের অগ্রসেনানী। পুরোদমে তাই দাওয়াহ্ এর কাজ চালিয়ে যেতে থাকলেন দু'জন। আর সেই জন্যই অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দিতে হল চরম মূল্য।

১৯৮১ সালের এক সন্ধ্যায় স্বামী কামালকে আবারো বন্দি করে সরকার। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করা হলো। তিনি নাকি সোভিয়েত রাশিয়াকে ধ্বংশের ষড়যন্ত্র করছেন। এর জন্য তিনি নাকি আফগান যুদ্ধে যাচ্ছেন। ক'দিনের জন্য গড়ে ওঠা এই ছোট্ট আনন্দময় সংসারে আবার নেমে এল শোকের ছায়া। আমিনার জীবনে নেমে আসে এক দুঃসহ স্মৃতির করুণতম অধ্যায়। তিনি নিজে শুধু না, তার আশে পাশের কেউই আশা করতে পারেনি, মানুষের জীবনে এমন দুঃখ আসতে পারে বা জীবন এতটা বেদনাদায়ক হতে পারে কিংবা সোনার সংসার এভাবে পুড়তে পারে। অল্প ক'দিনের মধ্যেই সামরিক কোর্টে কামালের বিচার শুরু হয়। বিচারে কামালের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ না দিয়েই সরকার তাকে ফাঁসি কাষ্টে ঝুলিয়ে শহীদ করে ফেলে।

১৯৮১ সনের ৬ই নভেম্বরের ভোর বেলা থেকে শুরু হলো আমিনা কুতুবের বৈধব্যের জীবন। তিনি হয়ে গেলেন ঘটনার আকর্ষিকতায় নির্বাক। বেদনায় নীল হয়ে গেলেন তিনি, হয়ে গেলেন স্বপ্নভাঙ্গা এক আহত কবি, জীবনের গতি তার হয়ে গেল শ্লথ, মৃত্যু কামনা ছাড়া তার সামনে থাকলো না কিছুই। ইসলামি আন্দোলনে কাজ করতে যেয়ে মানুষের জীবন এমনও হয়? সাহাবাদের ইতিহাস যেন আবারো ফিরে এল মিসরের মরুভূমিতে।

কামাল যেদিন শহীদ হন, সারা রাত আমিনা ঘুমাতে পারেননি। শোকে, ব্যাথায় বিহ্বল আমিনা সেদিন তার শহীদ স্বামীর কাছে লেখেন এক চিঠি। যে চিঠিখানা হতে পারে আরবি সাহিত্যের এক আমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। এতে একদিকে বেদনার ভারে নুয়ে পড়া এক মুজাহিদের আর্তচিৎকার যেমন ধ্বনিত হয়েছে, অন্যদিকে প্রত্যয়ের এমন এক সুর সেখানে শোনা যায়, যার তুলনা আমিনা কুতুব নিজেই।

তিনি লিখেছেনঃ
"এই চিঠি তোমার জন্য। হ্যাঁ, আমি তোমার কাছেই এই গভীর রাতে লিখছি...... মনে আছে আমার কথা? আমাকে ছেড়ে তুমি চলে গেছ, আর ফিরে আসনি। আমার এ লেখা তোমার কাছে এমন চিঠি যা তুমি কখনোই দেখবেনা, কখনোই তুমি তা পড়বেনা... আর কোনদিন তুমি তার উত্তরও দেবেনা। এতসব জানার পরেও আমি তোমাকে লিখছি...... আমার অশ্রুর বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার পরেও আমি লিখছি।

জানি, তুমি ফিরে আসার জন্য এবারে চলে যাওনি... আমার মন বলেছিল তুমি আর ফিরে আসবেনা। কিন্তু জালিমেরা আমার সাথে শেষ কথা বলার সুযোগও তোমাকে দেয়নি। আমি জানি তুমি এখন তোমার সেই ঘরের মাঝে বসে আছ, যেখানে থাকার জন্য আমাকে কত স্বপ্ন দেখাতে, আর নিজে কত সংগ্রাম করতে।

আমার চিঠি লেখা সেই জন্য। তোমাকে কি এমন সফলতার জন্য স্বাগত জানাতে হবেনা? আমি লিখছি কেন জান? অনেক কষ্টের পথ পাড়ি দিয়ে, অনেক বেদনা সয়ে সয়ে, আমার এই মাথাটা আবার তোমার কোলে রাখতে চাই...... আমার এই চিঠিটা অশ্রুভেজা বলে যদি না পড়তে পার, আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। তোমার কাছে হেঁটে হেঁটে যাওয়ার জন্য আমাকে একা ফেলে গেছ তো! তাই একটু কাঁদছি... এ কান্না বিরহ ব্যথায়, এ কান্না তোমাকে পাবার আশায়...".