Friday, September 3, 2021

আমীরে জামায়াতের পক্ষ থেকে আমিরুল মুমেনিন মোল্লা ওমরের প্রতি সালাম ও তালিবানদের প্রতি বাংলাদেশ জামায়াতের পূর্ণ সমর্থনের গল্প


জনগণ ইসলামী শরীয়া জারির পক্ষে ব্যাপকভাবে কিভাবে তাদেরকে সহযােগীতা করেছে তার একটি দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে তিনি বললেন, আফ-গানিস্তানে ব্যাপকভাবে আফিমের চাষ হতাে। আফিম ছিল এলাকার প্রধান অর্থকারী একটি ফসল। অতীতের সরকারগুলােও জনগণকে আফিম চাষে উৎসাহিত করেছিল । আফিমের ব্যবহার যেহেতু ইসলামী শরীয়তে হারাম তাই আমাদের আমীরুল মুমেনীন মােল্লা ওমর আল মােজাহেদী এই আফিম চাষ নিষিদ্ধের ইরাদা করে ঐ বিভাগের বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের ডেকে পরামর্শ চইলেন যে আফিম হারাম, এটার চাষ একেবারেই বন্ধ করতে চাই। তাই আফ-গানিস্তানের অর্থনীতি ঠিক রেখে কিভাবে এটা বন্ধ করা যায় তার পরামর্শ আমাকে দেন। তারা আফ-গানিস্তানের অর্থ ব্যবস্থা ক্ষতি না করে পুরা বিষয়টি স্টাডি করে পরামর্শ দিল যে, এটাকে পর্যায়ক্রমে বন্ধ করতে হবে, একবারেই বন্ধ করা ঠিক হবে না। কিন্তু এভাবে পর্যায়ক্রমে এটাকে বন্ধ করতে ১০ বছর সময় লাগবে। 
এরপর তিনি উপজাতি সরদারদের এক বৈঠকে আহ্বান করেন এবং আফিম হারাম হওয়ার কারণে এবছরই সারা আফ-গানিস্তানে আফিমের চাষ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে তাদের পরামর্শ চান। উপজাতি সরদাররা বললেন, আমরা আপনার নির্দেশ পালন করে এ বছরই সারাদেশে এই হারাম বস্তু আফিমের চাষ একেবারেই বন্ধ করে দিবাে। অতঃপর সারা আফ-গানিস্তান খুঁজে কেউ আফিমের একটা ফুলও সংগ্রহ করতে পারবে না। 
রুশ আগ্রাসন মুক্ত আফ-গানিস্তান ও মুজা-হিদ নেতাদের অনৈক্য:
রুশ আগ্রাসনের বিরূদ্ধে আফ-গানিস্তানে জেহাদ শুরু হওয়ার পর আফ-গান জিহাদের সঠিক অবস্থা জানার জন্য আমি কয়েকবারই পাকিস্তান গিয়ে পাক-আফ*গান সীমান্তে অবস্থিত বড় বড় কতিপয় মুজা-হিদ গ্রুপের নেতা যেমন গুলবুদিন হেক-মতিয়ার, বােরহান উদ্দিন রাব্বানী, আব্দুল রব রসূলে ছাইয়াফ, সেবগাতুল্লাহ মুজাদ্দেী, মাওলানা ইউনুস খালেস প্রমুখ, নেতৃতৃন্দের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। যা ঐ সময়ে ঢাকা থেকে প্রকাশিত জাতীয় পত্রিকায় কয়েক দফায় কয়েকবারই প্রকাশিত হয়েছিল। আফ-গানিস্তান রুশ দখল হতে মুক্ত হওয়ার পর প্রধম ২টি মুজা-হিদ গ্রুপ যথা হেজবে ইসলামী ও জমিয়তে ইসলামীর মধ্যে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে গৃহযুদ্ধ শুধু হয়ে যায়। এই গৃহযুদ্ধ অবসানের জন্য শুভাকাঙ্খীদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলেও উহা ফলপ্রসূ হয় নাই। প্রকাশ থাকে যে রাশিয়া ১৯৭৯ সনের ডিসেম্বরে আফ-গানিস্তান দখলের পরিকল্পনা নিয়ে তার সশস্ত্র বাহিনীকে আফ-গানিস্তানে প্রবেশ করায় এবং মােজাহেদীনদের সাথে দীর্ঘ ১০ বছর যুদ্ধ করে শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে ১৯৮৯ সনের ফেব্রুয়ারীতে আফ-গানিস্তান ত্যাগ করে।
অবশেষে কাবা শরীফের প্রধান ইমাম আব্দুল্লাহ বিন সােবাইলের নতৃত্বে একটি শক্তিশালী প্রতিনিধি দল গৃহযুদ্ধের অবসানকল্পে পাকিস্তানের পেশাওয়ারে নেতৃবৃন্দের সাথে একাধিক বৈঠক করেন। আমিও আমন্ত্রিত হিসাবে ঐ প্রতিনিধি দলে সামিল ছিলাম।
কিন্তু শত চেষ্টা করেও প্রধান দুটি মুজা-হিদ গ্রুপের নেতৃদ্বয়ের মধ্যে অর্থাৎ গুলবদিন হেক-মতিয়ার ও বােরহান উদ্দিন এর মধ্যে আপােস করানো সম্ভব
হয়নি ।।
হেকম-তিয়ার ও বােরহান উদ্দিন রাব্বানীর মুজাহেদীনের মধ্যে কাবুল দখলকে কেন্দ্র করে যে অব্যাহত গৃহযুদ্ধ চলছিল তাতে একদিকে যেমন মুসলমানদের রক্ত ঝরছিল । তেমনি সারা আফ-গানিস্তানে বিরাজ করছিল অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা । দেশের অভ্যন্তরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ও যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটির জনগণের কল্যাণের জন্য উভয় দলই স্ব স্ব নিয়ন্ত্রিত এলাকায় গৃহযুদ্ধের কারণে কোন মনােযােগ দিতে পারেনি।
এরই এক পর্যায়ে অর্থাৎ ১৯৯৪ সনে মােল্লা উমরের নেতৃত্বে তা*li*বান বাহিনী দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে আফ-গানিস্তানের গৃহযুদ্ধের অবসান ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তার লক্ষ্যে যুদ্ধ শুরু করে এবং অল্পদিনের মধ্যেই জনগণের বিপুল সমর্থন নিয়ে হেক-মতিয়ার ও রব্বানীর যৌথ বাহিনীকে পরাস্ত করে কাবুল দখল করে নেয়। হেকম-তিয়ার, বােরহান উদ্দিন রব্বানী ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা ইরানে আশ্রয় নেয়। অল্প দিনের মধ্যেই তা*li*বান বাহিনী আফ-গানিস্তানের ৯৫% ভাগ এলাকা দখল করে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে। 


তখনই ইহুদীদের মুরুব্বী ও তাদের ক্রীড়নক আমেরিকা নিজের দেশে সন্ত্রাসী হামলার (টুইন চাওয়ার ও পেন্টাগনে সিভিল প্লেন নিয়ে বিমান হামলার) একটি নাটক করে তাদের দৃষ্টিতে বিশ্বের সেরা সন্ত্রাসী ওসামা বিন লাদেন এবং তার আশ্রয়দাতা আফ-গান সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও জাতিংঘ সনদ উপেক্ষা করে আফ-গানিস্তানের অভ্যান্তরে সর্বাত্মক বিমান হামলা শুরু করে দেয়।
ফলে এই হামলায় নারী শিশু নির্বিশেষে অসংখ্য সাধারণ মানুষ প্রাণ হারায় ও আহত হয়। আমেকিা এই পৈচাশিক নরহত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং আফ-গানিস্তানের এই গরীব দেশটির স্থাপনাসমূহ যেমন হাসপাতাল, খাদ্য গুদাম, মসজিদ, মাদ্রাসা, শহর নগরের বাড়ী-ঘর ধ্বংস করার টার্গেট নিয়ে বােমা ফেলে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। উদ্দেশ্য তা*li*বান*দের শক্তিকে দুর্বল করে এবং তা*li*বান বিরােধী পরাজিত উত্তরীয় জোটকে শক্তিশালী করে আফ-গান গৃহযুদ্ধকে প্রলম্বিত করা যাতে এই বীরের জাতিরা নিজেরা নিজেরা যুদ্ধ করে শেষ হয়ে যায় ।
আফ-গানিস্তানের মাটিতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই দেশটির ব্যাপারে আমি বিশেষভাবে আগ্রহশীল হই এবং প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য কয়েকবারই আমি পাক-আফ-গান বর্ডারে অবস্থিত মুজা-হিদিনদের হেড কোয়ার্টার ভিজিট করি। কিন্তু আফ-গানিস্তানের অভ্যন্তরে আমি কখনও সফর করিনি। অবশেষে আল্লাহ রাব্দুল আলামিন এর একটা উত্তম সুযােগ করে দেন।
#আমার আফ-গানিস্তান সফরের বিবরণ:
অক্টোবর ২০০০ সানের ২৭, ২৮ ও ২৯ তারিখে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে ঐ সম্মেলনে যােগদান করি। সম্মেলনে যােগদানের এই সুযােগ আমি আফ-গানিস্তান সফরের ইরাদা করি। ভাগ্যক্রমে আল্লাহ তায়ালা একটা সুন্দর ব্যবস্থা করে দেন। ইসলামাবাদের যে সম্মেলনটিতে বিদেশী। প্রতিনিধিরা শরীক হয়ে বক্তব্য রাখছিলেন ওখানেই স্টেজে আমার পার্শ্বে উপবিষ্ট আফ-গান দূতাবাসের ফাস্ট সেক্রেটারীর সাথে আমার পরিচয় হয়। তার সাথে আমার আরবীতেই কথাবার্তা হচ্ছিল। তাকে আমি বললাম, আমি দুনিয়ার বহুদেশ সফর করলেও এ পর্যন্ত আফ-গানিস্তান পফরের সৌভাগ্য হয়নি। আমি আমার এই যাত্রায় আফ-গানিস্তানে সফরের দৃঢ় ইরাদা রাখি। তিনি আমার ভিসা ইত্যাদির ব্যবস্থা অল্প সময়ের ভিতরে করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। আমি পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর জনাব কাজী হুসাইন আহমদের কাছে আমার উক্ত সফরের ইচ্ছা প্রকাশ করি এবং আমাকে এই সফরের ব্যাপারে সহযােগিতা দানের অনুরােধ করি। তিনি ঐদিনই অর্থাৎ ৩১ অক্টোবর সীমান্ত প্রদেশের আমীর জনাব মাওলানা এডভােকেট ইব্রাহীম সাহেবকে খবর দিয়ে ইসলামাবাদে আনান এবং তাকে অমার সফরের যাবতীয় ব্যবস্থা করার এবং গাড়ীসহ আফ-গান সফরে আমার সাথী হওয়ার নির্দেশ দেন।
আমি ইসলামাবাদ হতে ঢাকায় আমার ফিরতি সফরের বুকিং কনফার্ম করে সন্ধ্যার দিকে পেশওয়ারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই এবং রাত ১০টার মধ্যে পেশওয়ার পৌঁছে খানাদানা সেরে ঘুমিয়ে পড়ি। অতঃপর ভােরে কিছুক্ষণ পায়চারী করে গােসল ও নাস্তা সেরে আফ-গানিস্তান সফরের প্রস্তুতি নিয়ে ইব্রাহিম সাহেবের সাথে অফিসে গিয়ে হাজির হই। ইব্রাহিম সাহেব গিয়ে আমার ও উনার জন্য ভিসা ও ফরেন মিনিষ্ট্রির গেস্ট যাতে আমাকে করা হয় এবং মােল্লা উমরসহ সর্বোচ্চ দায়িত্বশীলদের সাথে যাতে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয় তার জন্য জরুরী চিঠিপত্র হাসিল করেন।
অতঃপর আমরা পাহাড়ী পথে চলার উপযােগী একটি প্রাইভেট পিকআপ গাড়ী নিয়ে খাইবার গিরিপথ দিয়ে ল্যান্ডি কোটাল হয়ে ১লা নভেম্বর আসরের ওয়াক্তে তুরখাম গিয়ে হাজির হই। তুরখাম হলাে পাক এলাকাস্থ উপজাতীয় এলাকার সর্বশেষ চেকপােষ্ট।
সেখানে থেকে আফ-গানিস্তানে প্রবেশ করে জালালাবাদ হয়ে কাবুল যাওয়া যায়।
উপমহাদেশকে হিমালয় পর্বত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলাে হতে আলাদা করে রেখেছে। আফ-গানিস্তান হতে পাকিস্তান প্রবেশ করার জন্য ২টি গিরিপথই আছে। একটি হলাে খাইবার গিরিপথ। এই গিরিপথ দিয়ে তুরখাম হয়ে পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশে প্রবেশ করা যায়। অন্যটি হলাে বােলান গিরিপথ। বােলান গিরিপথ দিয়ে আফ-গানিস্তান হতে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে প্রবেশ করা যায়।
আমরা যখন আফ*গান-পাকিস্তান সীমান্ত চৌকী তুরখামে পৌছি তখন আসরের ওয়াক্ত। আমরা ওজু করে সমজিদে আসরের নামায আদায় করে সীমান্ত চৌকি হতে যাবতীয় অনুষ্ঠানাদি সেরে প্রবেশ করতে যাবাে তখন সীমান্ত প্রহরীরা আমাদের কাছে গাড়ীর পারমিট তলব হবে। আমরা আমাদের নিজেদের জন্য ভিসাসহ যাবতীয় জরুরী। কাগজপত্র আনলেও ভুলে গাড়ীর পামিট আনিনি। ফলে আমরা হােম সেক্টেকারীর নিকট হতে ফোনে অনুমতি হাসিল করায় রাত্রি অর্থাৎ সন্ধ্যার পর বন্ধ গেট আমাদের জন্য খুলে দেয়া হয়।
আসর হতে মাগরিব পর্যন্ত আমরা সীমান্ত চৌকিতেই অবস্থান করি এবং সীমান্ত চৌকির দায়িত্বশীল কর্মচারীরা যথেষ্ট যত্ন সহকারে আমাদের চা নাস্তা খাওয়ান। আমরা প্রবেশ পথ দিয়ে আফ-গানিস্তানের উপজাতীয় এলাকায় প্রবেশ করে আফ-গানিস্তানস্থ সীমান্তের কাস্টমস অফিস থেকে যাবতীয় অনুষ্ঠানাদি সেরে সােজা আফ-গানিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী জালালাবাদের দিকে রওয়ানা হই। রাত আটটা নাগাদ জালালাবাদ উপস্থিত হয়ে প্রটোকল অফিসারের সাথে যােগাযােগ করলে তিনি আমাদের সারকারী গেষ্ট হাউসে পৌছিয়ে দেন। এশার নামায আদায় করে রাতের খানা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আমি জালালাবাদ পৌছেই প্রটোকল অফিসারের কাছে কাবুল যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করি। তিনি বললেন, জালালাবাদ হতে সপ্তাহে মাত্র ১দিন বিমান সার্ভিস চালু আছে।
সুতরাং ৫,৬ দিনের আগে আপনি কোন বিমান পাচ্ছেন না। একথা শুনে আমি কাবুল সফরের পরিকল্পনা বাদ দেই এবং জালালাবাদের গভর্ণরের সাথে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার জন্য তাকে অনুরােধ করি ।।

#ডেপুটি গভর্ণরের সাক্ষাৎ:
পরের দিন ভােরে নামায, পায়চারী ও গােসল শেষ করে নাস্তা করে নেই। নাস্তার সময় প্রটোকল অফিসার খবর দেন যে, আজই অর্থাৎ ২রা নভেম্বর বেলা ১১টায় গভর্নর হাউসে ডেপুটি গভর্ণর জনাব মােল্লা সাদরে আলম আমাকে সাক্ষাতের সময় দিয়েছেন। কেননা গভর্ণর ঐদিন জালালাবাদে ছিলেন না। আমি আমার সাথী সীমান্ত প্রদেশের আমীর এডভােকেট ইব্রাহীম সাহেবকে নিয়ে ১১টা বাজার সামান্য পূর্বে গভর্ণর হাউজে হাজির হই। ওয়েটিং রুমে কিছুক্ষণ অবস্থান করার পরেই ডেপুটি গভর্ণর আমাদেরকে সাক্ষাৎকার দেন। পারস্পারিক সালাম, মােসাফাহা, কোলাকুলি ও কুশল বিনিময়ের পর ডেপুটি গভর্ণরের সাথে আমার আলােচনা শুরু হয়। আমি জামায়াতের আমির জনাব গােলাম আযম সাহেব ও জামায়াত নেতৃবৃন্দের সালাম তাকে পৌছাই এবং অনুরােধ করি তিনি যেন আমার এবং আমীর জামায়াতের সালাম আফ-গানিস্তানের আমীরুল মুমেনীন মােল্লা মােহাম্মদ ওমর আল মুজা-হিদকে পৌছান। 
আমি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর এ পরিচয় তার কাছে থাকলেও ১৯৬২ সনের পাক পালামেন্টে আমি ও সীমান্ত প্রদেশের মুফতি মাহমুদ (এক সর্বজন পরিচিত ব্যক্তিত্ব। তিনি এক সময় সীমান্ত প্রদেশের চীফ মিনিষ্টারও ছিলেন ।) এক সংঙ্গে পাক পার্লামেন্টের মেম্বর ছিলাম তা তিনি আমার কাছে জেনে বেশ আনন্দিত হয়েছিলেন।
১৯৮৯ সনে আফ-গানিস্তান থেকে রাশিয়ার বের হয়ে যাওয়ার পর মুজহেদীনদের পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধে আমরা যে খুবই মর্মাহত ছিলাম একথা তাকে বলি। অতঃপর বর্তমান তা*li*বান সরকার কাবুলসহ দেশের প্রায় ৯৫% ভাগ ভূ-ভাগ দখল করে দেশে শান্তি ও নিরাপত্তা বহাল করায় জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ তা*li*বান সরকারের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন দান করেছে, সে কথাও তাকে অবহিত করি। আমি আরবী ভাষায় তার সাথে কথা বলছিলাম এবং তিনি আমার কথা বুঝতে ছিলেন। অতঃপর তিনি কথা শুরু করেন। তিনি প্রথমেই বলেন যে, অবশ্যই জামায়াতে ইসলামী আফ-গান জিহাদে দেশকে রুশ কবল মুক্ত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে আমাদের বিশ্বাস জামায়াতের এই ভূমিকা কোন ব্যক্তি বা গােষ্ঠীর জন্য ছিল না, ছিল নীতি ও আদর্শের জন্য। তা*li*বান সরকার গৃহযুদ্ধের অবসান করে। ঐ নীতি ও আদর্শ অর্থাৎ শরিয়তের আইন সারাদেশে চালু করেছে। যার জন্য জামায়াতে ইসলামীসহ দুনিয়ার ইসলামী আন্দোলনসমূহ আফ-গান জিহাদে সাহায্য ও সমর্থন দিয়েছিল। তিনি দ্বিতীয় যে কথাটি বললেন, তা হলাে দেশ রুশ দখল মুক্ত হওয়ার পর হেকম-তিয়ার ও বােরহান উদ্দিন রাব্বানীর বাহিনীর মধ্যে কাবুল দখলকে কেন্দ্র করে যে ভ্রাতৃঘাতি দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এই যুদ্ধ ৩৬ হাজার মুসলমান নিহত হয়েছে। এই উভয় দল ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধে এতই ব্যস্ত ছিল যে, যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটির আইন-শৃঙ্খলা বহাল করে জনগণের কল্যাণের জন্য তারা কোন কাজই করতে পারেনি। আমরা অর্থাৎ তা*li*বান সরকার অল্প দিনের মধ্যেই। কাবুল দখল করে সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা বহাল করেছি। জনগণ আমাদেরকে ব্যাপকভাবে সহযােগিতা দিয়েছে। আর আমরা কোন রকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব না করে সারাদেশে শরীয়াতের আইন চালু করেছি। আমাদের সাথে কোন দেশের শত্রুতা থাকা উচিত নয় ।
কিন্তু রাশিয়া ও আমেরিকা আমাদের বিরুদ্ধে আমাদের পরাজিত শত্রুকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে লড়াই করতে লাগিয়ে দিয়েছে। আসলে আমাদেরকে তারা শত্রু এই জন্য মনে করে যে, আমরা আফ-গানিস্তানে পুরাপুরি ইসলামের আইন জারি করেছি। ফলে তাদের শত্রুতা প্রকৃতপক্ষে ইসলামের সাথে আমাদের সাথে নয় ।
জনগণ ইসলামী শরীয়া জারির পক্ষে ব্যাপকভাবে কিভাবে তাদেরকে সহযােগীতা করেছে তার একটি দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে তিনি বললেন, আফ-গানিস্তানে ব্যাপকভাবে আফিমের চাষ হতাে। আফিম ছিল এলাকার প্রধান অর্থকারী একটি ফসল। অতীতের সরকারগুলােও জনগণকে আফিম চাষে উৎসাহিত করেছিল । আফিমের ব্যবহার যেহেতু ইসলামী শরীয়তে হারাম তাই আমাদের আমীরুল মুমেনীন মােল্লা ওমর আল মােজাহেদী এই আফিম চাষ নিষিদ্ধের ইরাদা করে ঐ বিভাগের বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের ডেকে পরামর্শ চইলেন যে আফিম হারাম, এটার চাষ একেবারেই বন্ধ করতে চাই। তাই আফ-গানিস্তানের অর্থনীতি ঠিক রেখে কিভাবে এটা বন্ধ করা যায় তার পরামর্শ আমাকে দেন। তারা আফ-গানিস্তানের অর্থ ব্যবস্থা ক্ষতি না করে পুরা বিষয়টি স্টাডি করে পরামর্শ দিল যে, এটাকে পর্যায়ক্রমে বন্ধ করতে হবে, একবারেই বন্ধ করা ঠিক হবে না। কিন্তু এভাবে পর্যায়ক্রমে এটাকে বন্ধ করতে ১০ বছর সময় লাগবে।
এরপর তিনি উপজাতি সরদারদের এক বৈঠকে আহ্বান করেন এবং আফিম হারাম হওয়ার কারণে এবছরই সারা আফ-গানিস্তানে আফিমের চাষ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে তাদের পরামর্শ চান। উপজাতি সরদাররা বললেন, আমরা আপনার নির্দেশ পালন করে এ বছরই সারাদেশে এই হারাম বস্তু আফিমের চাষ একেবারেই বন্ধ করে দিবাে। অতঃপর সারা আফ-গানিস্তান খুঁজে কেউ আফিমের একটা ফুলও সংগ্রহ করতে পারবে না।
তিনি আরবীতে অল্প কথা বলেই পশতু ভাষায় কথা বলা শুরু করলেন। ইব্রাহীম সাহেব আমাকে বুঝাবার জন্য উর্দুতে উহা অনুবাদ করছিলেন। সাক্ষাৎকারটি শেষ হওয়ার পর চা-নাস্তা খেয়ে ডেপুটি গভর্নরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা জালালাবাদ ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে হাজির হই। আমরা যখন ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছাই তখন। ইউনিভার্সিটির ক্লাস ছুটি হয়ে গিয়েছিল। ফলে আমরা ইউনিভার্সিটির অফিসে গিয়ে হাজির হই। এখানে ইউনিভার্সিটির অফিস সেক্রেটারী তার অফিসে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানান ও সাক্ষাৎকার দেন। তিনি বললেন, আফ-গানিস্তানে মােট ৬টি ইউনিভার্সিটি আছে। জালালাবাদ ইউনিভার্সিটিতে সাড়ে তিন হাজার ছাত্র অধ্যয়ন করে। এখানে মােট ৬টি ফ্যাকালটি আছে। আফ-গানিস্তানে সর্বত্র বেশ কিছু উচু মানের দ্বীনি মাদ্রাসা আছে। এসব মাদ্রাসা হতে পাস করা ছাত্ররা ইউনিভার্সিটির শরীয়া ফ্যাকলটিতে ভর্তি হতে পারে। তিনি আরাে বললেন, কান্দাহারের উপকণ্ঠে ১টি জামেয়া অর্থাৎ (ইউনিভার্সিটি) করা হয়েছে। যেখানে কোরআন-হাদীস তালিমের সাথে সাথে কম্পিউটার ব্যবহার ও সামরিক শিক্ষাও দান করা হয়।
মহিলাদের শিক্ষার ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি বললেন, মহিলাদের প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য প্রতিষ্ঠান আছে এবং সেখানে তারা প্রয়ােজনীয় প্রাথমিক শিক্ষা পাচ্ছে। তবে শরীয়াতের সীমার মধ্যেথেকে উচ্চতর শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করতে একটু বিলম্ব হবে।
আফ-গানিস্তানের সংবিধান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, এখনও কোন নতুন সংবিধান তৈরি করা হয়নি। তবে দাউদের আমলের সংবিধানের অনৈসলামিক ধারাসমূহ বাতিল করে তদস্থানে ইসলামী ধারা সংযােজন করা হয়েছে। আপাতত ঐ সংবিধানই দেশে চাল আছে।
ইনশাআল্লাহ পরবর্তী পর্যায়ে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সংবিধান তৈরি করে উহা দেশে চালু করা হবে। তার কাছে প্রশ্ন করে আমরা আরাে জানতে পেলাম যে মন্ত্রীসভার বাইরে আমীরুল মুমেনীন মােল্লা মুহাম্মদ ওমরকে পরামর্শ দেয়ার জন্য ছােট একটা পরামর্শ সভা অর্থাৎ মজলিশে শূরা আছে।
ইউনিভার্সিটি দেখা শেষ করে আমরা সরাসরি সরকারী মেহমানখানায় চলে আসি। দুপুরের খানা খেয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে
আসরের নামায আদায় করে জালালাবাদের উপকণ্ঠে প্রায় ৫০ কিঃ মিঃ দূরে একটি প্রাচীন দ্বীনি মাদ্রাসা দেখতে যাই। আমাদের গাড়ি যখন মাদ্রাসায় গিয়ে পৌঁছে তখন মাগরিবের আযান হচ্ছিল। আমরা ছাত্রদের সাথেই নামায আদায় করি। মাদ্রাসায় তখন আবাসিক ছাত্র হােস্টেল সুপার ছাড়া অন্য কোন শিক্ষক বা মুহতামেম ছিলেন না। এ মাদ্রাসাটি প্রায় ১০০ শত বছর পূর্বে আফ-গানিস্তানের একজন বিশিষ্ট বুজুর্গ আলেম
প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ইংরেজদের সাথে জিহাদ করতে গিয়ে শাহাদত বরণ করেন। মাদ্রাসাটি পরিদর্শন করে আমরা জালাবাদে সরকারী মেহমানখানায় ফিরে আসি। আমরা পূর্ণ একটি দিন ও দু'রাত আফ-গানিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী জালালাবাদে অবস্থান করে প্রয়ােজনীয় তথ্য ইত্যাদি সংগ্রহ করে ৩ নভেম্বর ভােরে নামায, পায়চারী ও নাস্তা সেরে পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে তুরখামের দিকে রওয়ানা হই।
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তুরখামের চেক পােস্ট অতিক্রম করে খাইবার গিরিপথ দিয়ে ল্যান্ডি কোটাল হয়ে দুপুরের দিকে পেশওয়ারে উপস্থিত হই । পেশওয়ারে জনৈক জামায়াতে ইসলামী নেতার বাড়িতে আমার থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এখানে ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সাথে ১টি বৈঠকেরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রাতে আমি এই বাড়িতেই অবস্থান করি এবং খুব ভােরে পেশওয়ার বিমানবন্দর হতে পিআইএ'র বিমানযােগে ঢাকার উদ্দেশ্যে করাচী রওয়ানা হই। এভাবেই আমার বহু প্রত্যাশিত অথচ সংক্ষিপ্ত আফ-গানিস্তান সফর শেষ হয়।

  • আফ-গানিস্তানের দৃষ্টি আকর্ষণীয় কয়েকটি বিশেষ দিক:

১। এখন আফ-গানিস্তানে যে তা*li*বান গভর্নমেন্ট কায়েম হয়েছে।রাশিয়ার সাথে যুদ্ধের সময় এদের অধিকাংশ ছিল মােল্লা ইউনুস খালিসের নেতৃত্বে হিজবে ইসলামী দলের মুজা-হিদ। এরা আলেম প্রধান দল। মােল্লা ইউনুস খালেস একজন উঁচু দরের দরসে নিজামীর আলেম। তার সাথে আমার কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছে । তিনি এখন বৃদ্ধ ও শয্যাশায়ী। রিয়াদের রাজকীয় মেহমানখানায় তার সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎ হয়। তিনি তখন ওখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ দলের বেশীরভাগ মােজাহেদ দ্বীনি মাদ্রাসায় শিক্ষাপ্রাপ্ত। হেকম-তিয়ার দেশ ত্যাগ করার পর হেকম-তিয়ারের দলের অধিকাংশ মুজা-হিদরা এই দলে শামিল হয়েছে। হেকমতি-য়ারের দলের নামও ছিল হিজবে ইসলামী । এদের বেশিরভাগ পাকিস্তান সংলগ্ন আফ-গানিস্তানের অধিবাসী এবং তাদের মাতৃভাষা পশতু।
২। আফ-গানিস্তানের অধিবাসীদের শতকরা ৭০% লােক পশতু ভাষাভাষি। এদেরকে পাখতুন বলা হয়। সাড়ে ছয় লক্ষ বর্গকিলেমিটার আয়তনের এই দেশটি ২৮টি স্টেট অর্থাৎ প্রদেশে বিভক্ত। পস্তু ভাষাভাষি লােকেরাই বিগত কয়েক'শ বছর ধরে আফ-গানিস্তান শাসন করে এসেছে। উত্তরের অল্পসংখ্যক লােক ফার্সী ভাষায় কথা বলে তবে পস্তু ও ফার্সি দুটোই আফ-গানিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। আলেমদের অধিকাংশই ভাল আরবী জানে।।
৩। আফ-গানিস্তানের রাস্তাঘাট যুদ্ধের কারণে খারাপ থাকলেও যােগাযােগের জন্য ব্যাপকভাবে বাস, ট্রাক ও ট্যাক্সি ব্যবহার হচ্ছে। যার সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। আমরা জালালাবাদ শহরে। বেশ কিছু গাড়ির ডিলারদের শাে রুম দেখলাম। যেখানে বিক্রির জন্য প্রচুর গাড়ি মওজুদ ছিল।
৪। ইরানের সাথে সম্প্রতি আফ-গানিস্তানের সম্পর্ক কিছু উন্নত হওয়ায় সরাসরি ইরান হতে পাইপ লাইনের মাধ্যমে আফ-গানিস্তানে পেট্রোল আমদানি করা হচ্ছে। ফলে এখানে পেট্রোলের লিটার মাত্র ১৩/- টাকায় এবং ডিজেল ৮/- টাকায় বিক্রয় হচ্ছে (পাক মুদ্রায়)। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ পাকিস্তানে পেট্রোলের লিটার ৩০-৪০/- টাকা।
৫। আফ-গানিস্তানের মুদ্রা একেবারেই সস্তা, অর্থাৎ পাকিস্তানের ১/টাকার সমান আফ-গানিস্তানের ১২০/- টাকা। অথচ যুদ্ধের আগে পাকিস্তানের ও আফ-গানিস্তানের মুদ্রা ছিল সমমানের। আফ-গানিস্তানের সর্বত্র পাকিস্তানী টাকা অবাধে চলছে।
৬। আফ-গানিস্তানের অর্থনীতি কৃষি নির্ভর। ফসল ও ফলমূলই হলাে তাদের প্রধান আয়করী পণ্য। আমি জালালাবাদ যাবার সময় রাতে গিয়েছি। ফলে রাতের অন্ধকারে আশেপাশে তেমন কিছু দেখতে পাইনি। তাই ফেরার পথে দিনে ফিরেছি। জালালাবাদ হতে রওয়ানা হয়ে প্রায় ১০০ কিঃ মিঃ রাস্তা সমতল ভূমি দিয়ে অতিক্রম করি যার দু'ধারেই ছিল গম, ভূট্টা, তুলা, ধান ও তরিতরকারীর ক্ষেতের সমাহার। এরপরে শুরু হয় পাহাড়ী দুর্গম পথ। যেখানে ক্ষেতে ফসল না থাকলেও পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে নানা ধরনের ফলের গাছ ছিল। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার পাক আফ-গান সীমান্তে বসবাসকারী একজন পস্তু ভাষী লােক। রাশিয়ার সাথে যুদ্ধের সময় সে জালালাবাদ সেক্টরে মুজা-হিদদের সাথে মিলে স্থল যুদ্ধ করেছে। ফলে সে আমাদেরকে যুদ্ধের ক্ষেত্রগুলাে চিহ্নিত করে দেখাতে দেখাতে পথ অতিক্রম করছিল এবং রাশিয়ার সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করে কিভাবে জয়ী হয়েছিল। তার বিবরণ দিচ্ছিল। আমরা গভীর মনােযােগের সাথে তার বিবরণ শুনছিলাম।

[দেশ থেকে দেশান্তর/ মুমতাজুল মুহাদ্দিস শহীদ একেএম ইউসুফ রহ/পৃ: ১৮৫-১৯৪]