Friday, September 3, 2021

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও রক্তাক্ত আফগান - অধ্যাপক গোলাম আযম

তালেবান সরকারের সামগ্রিক নেতৃত্ব দিয়েছেন মাদরাসায় পড়া ওলামায়ে কেরাম। তাদের ঈমান ও ইখলাস প্রশ্নাতীত। মােল্লা ওমর ও তার সাথীগণ নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে কাজ করেননি। সত্যিকার ইসলামী হুকুমাত কায়েম করার জন্যই তারা সরকার গঠন করেছিলেন। তাই তারা আল্লাহ তাআলার অলৌকিক সাহায্য ও জনগণের সক্রিয় সমর্থন পেয়েছিলেন। 
বিপুল জনসমর্থনের ফলে তালেবানরা অল্প সময়ের মধ্যেই রাজধানী কাবুলও দখল করতে সমর্থ হয়। প্রেসিডেন্ট বুরহানুদ্দীন রাব্বানী কাবুল থেকে পালিয়ে যান। সরকারবিরােধী নেতা ইঞ্জিনিয়ার গুলবুদ্দীন হেকমত ইয়ারও তালেবানদের বাধা দেননি।  
আমেরিকার আফগানিস্তান দখল

আমেরিকা ইরাক দখলের পূর্বে আফগানিস্তান দখল করে নেয় এবং সেখানে তাদের পুতুল সরকার কায়েম করে। আমেরিকা কর্তৃক ইরাক দখল সম্পর্কে আলােচনার সাথে আফগানিস্তান দখল সম্পর্কেও লেখা প্রাসঙ্গিক মনে করছি।
আফগানিস্তানের বাদশাহ জহির শাহকে উৎখাত করে বামপন্থি শক্তিগুলাে রাশিয়ার সাহায্যে ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু তাদের ব্যর্থতার কারণে সােভিয়েত রাশিয়ার সেনাবাহিনী ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে সরাসরি আফগানিস্তান দখল করে নেয়। তখন এ দেশ থেকে আওয়ামী লীগ ও বামপন্থিদের একটি ডেলিগেশন কাবুল সফর করে এ দেশে কাবুল স্টাইলে বিপ্লব সাধন করার সংকল্প ঘােষণা করে। আমি পত্রিকায় জনাব আবদুর রাজ্জাকের মুখে এ ঘােষণার কথা জানতে পারি। 

আফগানিস্তানের ছােট বড় সাতটি ইসলামী দল ও লাখ লাখ মুসলমান শরণার্থী হয়ে পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশে আশ্রয় নেয়। তখন জেনারেল জিয়াউল হক পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। তিনি শরণার্থীদের খেদমত করার জন্য বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর প্রত্যক্ষ সহযােগিতা, পাকিস্তানের জনগণের আবেগপূর্ণ সমর্থন ও উপসাগরীয় আরব দেশের বিপুল সাহায্যে দশ বছর যুদ্ধ করে রাশিয়াকে পরাজিত করে। ১৯৯২-এর ২৮ আগস্ট কাবুলে মাওলানা সিবগাতুল্লাহ মুজাদ্দেদীকে প্রেসিডেন্ট করে মুজাহিদদের কোয়ালিশন সরকার কায়েম হয়। 

যাদের নেতৃত্বে আফগানিস্তান রাশিয়ার খপ্পর থেকে মুক্ত হলাে তাদের মধ্যে নেতৃত্বে কোন্দলের ফলে সেখানে সুশাসন কায়েম হতে পারল না। কান্দাহারের অধিবাসী মােল্লা মুহাম্মদ ওমর নামক এক আফগান মুক্তিযােদ্ধা ছাত্রের নেতৃত্বে প্রথম কান্দাহারে মাদরাসা ছাত্রদের শাসন কায়েম হলাে। সারা আফগানিস্তানে আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছিল। কান্দাহারে সুশাসন কায়েম হওয়ায় আফগান জনগণের মধ্যে ছাত্রদের নেতৃত্ব জনপ্রিয় হয়ে উঠল। 

বিপুল জনসমর্থনের ফলে তালেবানরা অল্প সময়ের মধ্যেই রাজধানী কাবুলও দখল করতে সমর্থ হয়। প্রেসিডেন্ট বুরহানুদ্দীন রাব্বানী কাবুল থেকে পালিয়ে যান। সরকারবিরােধী নেতা ইঞ্জিনিয়ার গুলবুদ্দীন হেকমত ইয়ারও তালেবানদের বাধা দেননি। 

১৯৯৬-এর সেপ্টেম্বরে মােল্লা মুহাম্মদ ওমর আমীরুল মুমিনীন হিসেবে আফগান সরকারের প্রধান হন। সারা দেশে জনগণের মধ্যে ইসলামী জযবার জোয়ার সৃষ্টি হলাে। ব্যাপক জনসমর্থন পাওয়ায় দেশে আইন-শৃঙ্খলার প্রচুর উন্নতি হলাে। রাষ্ট্র পরিচালনার কোনাে অভিজ্ঞতা তাদের থাকার কথা নয়। তারা দীনী মাদরাসায় যে শিক্ষা লাভ করেছেন তাতে মযবুত ঈমান, উন্নত ব্যক্তিগত চরিত্র ও নেক নিয়তের অধিকারী অবশ্যই ছিলেন। আধুনিক শিক্ষিতদের সহযােগিতা তারা কতটুকু নেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তা আমার জানা নেই।


২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের বিখ্যাত দুটো টাওয়ার বিমান হামলায় ধ্বংস হওয়ার পর এর জন্য প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ওসামা বিন লাদেনকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবেই বিনা প্রমাণে দায়ী করে অভিযােগ করলেন, লাদেন আফগান মুক্তিযুদ্ধে স্বয়ং শরীক ছিলেন এবং তালেবান সরকারকে সফল করতে সহায়তা করেছিলেন। তিনি সৌদি নাগরিক হলেও সৌদি সরকারের নিকট অবাঞ্ছিত হওয়ায় আফগানিস্তানেই বসবাস করছিলেন। 

আমেরিকা লাদেনকে আফগানিস্তান থেকে বের করে দেওয়ার দাবি জানালে মােল্লা ওমরের সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের জন্য লাদেন দোষী বলে প্রমাণিত হলে সরকার তাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে সম্মত বলে জানানাে সত্ত্বেও বিনা প্রমাণে লাদেনকে সন্ত্রাসী হিসেবে আমেরিকার হাতে তুলে দিতে প্রবল চাপ দিতে থাকে। এ চাপে আফগান সরকার নতি স্বীকার না করায় আমেরিকা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালিয়ে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে আফগানিস্তান দখল করে গণহত্যা চালায়। ২০০১ সালে ১২ নভেম্বর মােল্লা ওমর কাবুল ত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং আমেরিকান বাহিনী কাবুল দখল করে নেয়। 

২০০১ সালের ৩১ ডিসেম্বর আফগানিস্তান সম্পর্কে আমার একটা প্রবন্ধ দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত হয়। ২০০২ সালের নভেম্বরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও রক্তাক্ত আফগান' নামে ৮০৮ পৃষ্ঠার এক বিশাল গ্রন্থে আমার ঐ লেখাটি শামিল করা হয়েছে। এতে ১৪৪ জন লেখকের প্রবন্ধ রয়েছে। গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন বর্তমানে দৈনিক নয়াদিগন্তের অন্যতম সম্পাদক জনাব মাসুদ মজুমদার। সম্পাদকের একটি দীর্ঘ মুখবন্ধও রয়েছে। আমার ঐ লেখাটিই এখানে পরিবেশন করছিঃ

পাশ্চাত্য সভ্যতা রক্ষার দোহাই দিয়ে এবং জাস্টিসের নামে আমেরিকা জাতিসংঘের একটি সদস্য দেশ আফগানিস্তানের সরকার ও জনগণের উপর যে বর্বর নির্যাতন চালিয়েছে তা মানবজাতির ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায়। পাশব শক্তির দাপটে যা ইচ্ছা তাই করা যায়, কিন্তু ইতিহাস নিরপেক্ষভাবে সব কিছুই যাচাই করে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ, সাধারণ ন্যায়বিচার, বিবেক, মানবতাবােধ, নৈতিক চেতনা ইত্যাদির দৃষ্টিতে এত বড় অপরাধ করা হলাে, যার প্রতিবাদ জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলও করতে সাহস করলেন না। তাহলে জাতিসংঘ কি লীগ অব নেশনের পরিণতির দিকেই এগােচ্ছে?

 গত অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমি ম্যানচেস্টার শহরে টেলিভিশনে বৃটিশ পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের চরম আবেগময় বক্তৃতা শুনলাম। সারকথা টুইন টাওয়ার, পেন্টাগন ও ওয়াশিংটনে হামলার উদ্দেশ্যে চারটি বিমানের ১৯ জন আত্মঘাতী হাইজ্যাককারীর তিনজন যে ওসামা-বিন-লাদেনের লােক তার প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। অবশ্য তা আমরা প্রকাশ করছি না। তাই তালেবান সরকারের নিকট আমাদের দাবি "Either surrender Usama or Surrender Power" (হয় ওসামাকে দাও, না হয় ক্ষমতা ছাড়)।

টুইন টাওয়ার ধ্বংসের জন্য এটুকু অস্পষ্ট কারণের দোহাই দিয়ে দুনিয়ার অন্যতম দরিদ্র ও অসহায় একটি দেশের উপর বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের নেতৃত্বে এত বিরাট রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস পরিচালনা করা কি সত্যিই সমর্থনযােগ্য হতে পারে? অথচ জাস্টিসের নামে এত বড় ইনজাস্টিস করা হলাে। জাস্টিসের সংজ্ঞাই বদলে গেল। শক্তিমানের জুলুমই কি জাস্টিস? 

 টুইন টাওয়ার গলে যেতে দেখলাম 

১১ সেপ্টেম্বর সকাল পৌনে নটায় নিউইয়র্ক থেকে সড়কপথে দশ ঘন্টার পথ দূরে ডেট্রয়েট শহরে টেলিভিশনে দেখলাম একটা টাওয়ারের উপরিভাগে আগুন জ্বলছে ও ধোয়ার কুণ্ডলী বের হচ্ছে। দেখতে দেখতেই আর একটি বিমান অপর টাওয়ারে লেগে ভেঙে পড়ল এবং তা থেকেও আগুন ও ধোঁয়া উঠছে। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছি। ১৫ মিনিটের মধ্যেই ১১০ তলা উঁচু টাওয়ার দুটোই গলে নিচে নেমে মাটিতে ঢুকে গেল। হতবাক হয়ে গেলাম। টিভি থেকে খবরে যা জানলাম তাতে মনে হলাে অলৌকিক ঘটনা। এ টাওয়ার দুটোকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাইড, প্রেসটিস ও ওয়েলথের প্রতীক মনে করা হতাে। এত বড় ঘটনা কেমন করে ঘটল? সন্ধ্যায় এক ডিনারের দাওয়াতে গেলাম। তিন-চারটি দেশের মেহমান ছিল। এ ঘটনা সম্পর্কে আমার মন্তব্য জানতে চাইলে বললাম, “এত বড় ঘটনা ঘটানাের ক্ষমতা ইসরাঈল ও আমেরিকা ছাড়া আর কারাে নেই”।

যে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের চারটি বিমান হাইজ্যাক হলাে ঐ এয়ারলাইন্সের টিকেট আমি ঢাকা থেকে নিয়ে গেলাম সস্তা হওয়ায়। ৩১ আগস্ট থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমেরিকার বহু শহরে মুসলিম উম্মাহ-ইন-আমেরিকা’-এর সাংগঠনিক কর্মসূচি অনুযায়ী আমার সফর চলছিল। এ ঘটনার পরই সব প্রােগ্রাম বাতিল হয়ে গেল। জনগণের মুখে ও পত্রপত্রিকায় প্রশ্ন উঠল, বিশ্বের গােটা মহাশূন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। তাদের সামরিক কেন্দ্র পেন্টাগনে বিমান কেমন করে আঘাত হানল? আমেরিকা কি তাহলে প্রতিরক্ষায় অক্ষম? চারটি আমেরিকান বিমান আমেরিকান পাইলটই চালাচ্ছিল। বিশ্বের সেরা গােয়েন্দা নেটওয়ার্ক কেন টের পেল না? 


এসব প্রশ্ন থেকে আত্মরক্ষার কৌশল 

আমার মনে প্রশ্ন সৃষ্টি হলাে যে, জনগণের এসব প্রশ্নের সদুত্তর প্রেসিডেন্ট বুশের নিকট

থাকায়ই কি কল্পিত অপরাধী আবিষ্কার করা প্রয়ােজন হয়ে পড়ল? এত বড় ঘটনা ঘটানাের সাধ্য বিন লাদেনের থাকলে তিনি আগেই তার শত্রুর বিরুদ্ধে হয়তাে তা প্রয়ােগ করতেন। উপসাগরীয় যুদ্ধকে উপলক্ষ করে আমেরিকান সামরিক ঘাঁটি সৌদি আরবে গড়ে ওঠে। ঐ ঘাঁটিতে বােমাবিস্ফোরণে অনেক মার্কিন সৈন্য নিহত হয়। এরপর সােমালিয়ায় আমেরিকান দূতাবাসে বােমা হামলা হয়। এতেও লাদেনকে দায়ী করা হয়। বিন লাদেন এ দায়িত্ব অস্বীকার করেন বটে, কিন্তু এ হামলা সমর্থন করেন। এ থেকেই আমেরিকা বিশ্বের সর্বত্র সন্ত্রাসী হামলার সাথে বিন লাদেনকে জড়িত করতে থাকে।

১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার জন্য লাদেন বাহিনীকে দোষী সাব্যস্ত করে বুশ-প্রশাসনের ব্যর্থতা থেকে আমেরিকার জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ফেরানাের ব্যবস্থা করা হয়। বুশ বিন লাদেনকে আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানান। তালেবান সরকার টুইন টাওয়ার হামলায় বিন লাদেন জড়িত বলে প্রমাণ দাবি করে। প্রমাণ দিতে পারলে লাদেনকে হস্তান্তর করতে রাজি তাও জানায়। প্রেসিডেন্ট বুশ ঐ ঘটনাকে আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে দাবি করেন এবং এ যুদ্ধের প্রতিপক্ষ বিন লাদেনকে সাব্যস্ত করেন। লাদেনকে তাদের হাতে তুলে না দিলে আফগানিস্তানের উপর হামলার হুমকি দেন। তালেবান সরকারের পৃষ্ঠপােষক পাকিস্তান সরকারের উপর হামলা যাতে না হয় সেজন্য পাকিস্তানের সামরিক সরকার লাদেনকে ঐ দেশ থেকে বের করে দেওয়ার জন্য তালেবান সরকারের সাথে দু-তিন সপ্তাহ ধরে কূটনৈতিক যােগাযোেগ চালায়। এতে ব্যর্থ হওয়ার পর আফগানিস্তানের উপর হামলায় পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার করতে সম্মতি দিতে পাকিস্তানকে বাধ্য করা হয়। পাকিস্তান তালেবান সরকারের পৃষ্ঠপােষকতা ত্যাগ করে। 

তালেবান সরকারের বক্তব্য 

রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগান মুজাহিদদের যুদ্ধে বিন লাদেনের বিরাট অবদান রয়েছে। বিন লাদেন স্বয়ং এ জিহাদে মুজাহিদের ভূমিকা পালন করেন এবং তার বিপুল সম্পদ ব্যয় করেন। উপসাগরীয় যুদ্ধের বাহানায় সৌদি আরবে আমেরিকা বিরাগ থেকে আত্মরক্ষার জন্য আফগানিস্তানে আশ্রয় নেন। এ অবস্থায় তিনি তালেবান সরকারের সম্মানিত মেহমান।

লাদেন আমেরিকার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মতৎপরতা চালানাের জন্য আফগানিস্তানে বিরাট নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন বলে আমেরিকার দাবি তালেবান সরকার অস্বীকার করে। এ অবস্থায় বিনা অপরাধে তাদের মেহমানকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া তারা ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যায় মনে করে। তাদের পৃষ্ঠপােষক পাকিস্তান সরকারের কূটনৈতিক চাপের মুখে ঘােষণা করে যে, ওসামা বিন লাদেন নিজের ইচ্ছায় আফগানিস্তান ত্যাগ করলে তাদের কোনাে আপত্তি নেই। কিন্তু তারা মেহমানকে তাড়াতে পারে না। 

একটি সঙ্গত প্রশ্ন 

বিন লাদেন নিজেকে নির্দোষ দাবি করে হেগ-এ অবস্থিত আন্তর্জাতিক আদালতে নিজেকে পেশ করলেন না কেন? ওখানে যুগােস্লাভ নেতা মিলােসেভিচের বিচার হচ্ছে। বিনা বিচারে ও বিনা দোষে সেখানে শাস্তি হয় না। তিনি একটি দেশকে এভাবে ধ্বংস হওয়া থেকে কি রক্ষা চেষ্টা করতে পারতেন না? এ দেশটিকে আমেরিকার হামলা থেকে তিনি এভাবে বাঁচানাের চিন্তা করলেন না কেন? নিজের নিরাপত্তার জন্য একটি দেশকে বলি হতে দিলেন কেন? এ প্রশ্নের জওয়াবে কেউ-ই বলতে পারেন না যে, লাদেন আফগানিস্তান থেকে সরে গেলেও তার সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক ধ্বংসের দোহাই দিয়ে আমেরিকা সেখানে হামলা চালাত না। এটা তখন অবশ্য সহজ হতাে না। পাকিস্তান নিজের স্বার্থেই হয়তাে তালেবান সরকারকে

রক্ষার জন্য কথিত নেটওয়ার্ক বন্ধ করার ব্যবস্থা করত। জাতিসংঘের মিশনকে দিয়ে তদন্ত করার দাবি জানানাে সম্ভব হতাে। যা হােক, যা ঘটে গেল এর পরিণাম কী? 

আফগানিস্তানে পুতুল সরকারের ভবিষ্যৎ 

জাতিসংঘের সহায়তায় জার্মানির 'বন'-এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কায়েমের যে চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে তাতে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র বিভাগ প্রফেসর বােরহানুদ্দীন রাব্বানীর নেতৃত্বে পরিচালিত নর্দান এলায়েন্সের হাতে দেওয়া হয়েছে। প্রফেসর রাব্বানী তালেবান সরকার কায়েম হওয়ার পর পূর্ব পর্যন্ত দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে কেমন যােগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন তা কারাে অজানা থাকার কথা নয়।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সাত দলীয় মুজাহিদ বাহিনীর প্রধান দুটো দলের একটির নেতৃত্বে তিনিই ছিলেন। অপরটির নেতা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার গুলবুদ্দীন হেকমতিয়ার। জিহাদে রাশিয়ার পরাজয়ের পর আফগানিস্তানে বিজয়ী মুজাহিদদের মধ্যে সরকার গঠনের ব্যাপারে চুক্তি হয়, তাতে কয়েক মাস একটি ক্ষুদ্র দলের নেতা মাওলানা সিবগাতুল্লাহ মুজাদ্দেদী প্রেসিডেন্ট হন। এরপর প্রফেসর বােরহানুদ্দীন রাব্বানী প্রেসিডেন্ট এবং ইঞ্জিনিয়ার শুলবুদ্দীন হেকমতিয়ারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা। সে অনুযায়ী রাব্বানী প্রেসিডেন্ট হন। কিন্তু হেকমতিয়ারকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দিতে নানা বাহানায় বিলম্ব করতে থাকেন। পাকিস্তান সরকারের উদ্যোগে এবং সৌদী বাদশার সহযােগিতায় মক্কা শরীফে আফগান নেতাদের সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় যে, রাব্বানী প্রেসিডেন্ট এবং হেকমতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। এরপরও রাব্বানী হেকমতিয়ারকে দায়িত্ব পালনের সুযােগ দেননি। 

রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইসলামের নামে ১০ বছর এ দুই নেতা একসাথে যুদ্ধ করে বিজয়ী হন। ইসলামের জন্যই বহু পাকিস্তানি ও আরব মুজাহিদ এ যুদ্ধে শরীক হন। পাকিস্তানে মাদরাসায় শিক্ষারত বাংলাদেশী ছাত্ররাও জিহাদে শরীক হয় এবং বেশ কয়েকজন শহীদ হয়। অত্যন্ত দুঃখ ও বিস্ময়ের বিষয় যে, উজবেক নেতা রাব্বানী ইসলামের চেয়ে গােত্রীয় স্বার্থকেই গুরুত্ব দিয়ে পাখতুন হওয়ার দোষে হেকমতিয়ারকে সরকারি ক্ষমতায় শরীক হতে দিলেন না। তাই রাব্বানী ৫/৬ বছর শাসনকালে রাজধানী কাবুলেও আইন-শৃঙ্খলা কায়েম করতে ব্যর্থ হন। 

তালেবান সরকার 

রাশিয়ার বিরুদ্ধে জিহাদে শরীকদের মধ্যে আফগানিস্তানের মাদরাসাগুলাের ছাত্ররা অত্যন্ত মুখলিস মুজাহিদের ভূমিকা পালন করে। রাব্বানী সরকারের কুশাসনে গােটা দেশে যখন বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীনতায় জনগণ অতিষ্ঠ, তখন মােল্লা মুহাম্মদ ওমর যটি ইসলামী জযবা নিয়ে ছাত্র সমাজকে ইসলামী হুকুমত কায়েমের আন্দোলনে শরীক হওয়ার ডাক দেন। 

দশ বছর আফগান জিহাদে শরীক ছাত্র মুজাহিদ মােল্লা ওমর যুদ্ধে একটি চক্ষু ফুরবানী দেন। রুশদের পরাজয়ের পর তিনি নিজ এলাকা কান্দাহারে এক মাদরাসায় শিক্ষকতা

করছিলেন। ইসলামী সরকারের বদলে গােত্রীয় সরকারের কুশাসনে অতিষ্ঠ জনগণের মধ্যে মােল্লা ওমরের ডাক সাড়া জাগায়। প্রথমে তিনি তার ছাত্র এবং আফগান জিহাদে শরীক ছাত্রদের নিয়ে কান্দাহার শহরে শান্তি-শৃঙ্খলা কায়েমের উদ্যোগ নেন। তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় জনগণ সাড়া দেওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই কান্দাহার তাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। 

মাদরাসার ছাত্রদের তালেবে ইলম' বলা হয়। এটা আরবী পরিভাষা। এর অর্থ হলাে বিদ্যান্বেষী। তালেব মানে তালাশকারী বা আকাক্ষী। ইলম তালাশকারীরাই তালেবে ইলম। তালেব শব্দের বহুবচন উর্দুতে তালেবান। মােল্লা ওমর তালেবানদের নিয়েই ইসলামী হুকুমত কায়েমের সূচনা করেন। তাই তাঁর সরকার তালেবান নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। 

আফগান জনগণ ঐতিহ্যগতভাবেই স্বাধীন মনােভাবের লােক। সাথে অস্ত্র বহন করা তাদের অভ্যাস। রাব্বানী শাসনে জনগণ সন্তুষ্ট না থাকায় এবং দেশে আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ায় রীতিমতাে অরাজকতা সৃষ্টি হয়। জনগণ নিরাপদে থাকতে চায়। তাই কান্দাহারে মােল্লা ওমরের আবেগময় নেতৃত্বে এবং তার তালেবান বাহিনীর আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে জনগণ এমন সাড়া দেয় যে, মােল্লা ওমরের নির্দেশে তাদের ব্যক্তিগত সব অস্ত্র তার হাতে জমা দেয়। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই কান্দাহার প্রদেশে পূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তা কায়েম হয়ে যায়। জনসাধারণের এটাই তাে সবচেয়ে বড় এবং প্রথম দাবি। কান্দাহার তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে আসার পর বিদ্যুৎগতিতে গােটা দেশে মােল্লা ওমরের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে এবং আশপাশের প্রদেশেও ব্যাপক জনসমর্থনের খবর পাওয়া যায়। দলে দলে ছাত্র ও যুবকরা মােল্লা ওমরের তালেবান বাহিনীতে শরীক হতে থাকে এবং কয়েক মাসের মধ্যেই বেশ কয়টি প্রদেশ তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে আসে। রাব্বানী সরকার জনগণের আস্থা সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলায় এবং তারা তালেবানদের সক্রিয় সমর্থক হওয়ায় তালেবানদের অগ্রগতি রােধ করতে ব্যর্থ হয়। 

হেকমতিয়ারের বিরাট বাহিনী যে এলাকায় অবস্থান করছিল তা কাবুল থেকে খুব দূরে নয়। তালেবানদের এ বিজয় অভিযানে হেকমতিয়ার পূর্ণ নিরপেক্ষতা পালন করে নীরব সমর্থনই দান করেন। এমনকি তালেবান বাহিনী যখন কাবুল দখলের জন্য এগিয়ে আসে তখন হেকমতিয়ার বাহিনী তাদের উৎসাহই দেয়। ফলে রাব্বানীর বাহিনী কাবুল থেকে পালিয়ে উত্তরাঞ্চলে চলে যেতে বাধ্য হয়। বিনা যুদ্ধে রাজধানী কাবুল তালেবানদের দখলে চলে আসে। মােল্লা ওমরের এ সফল গণবিপ্লব বিস্ময়কর। 

উজবেক নেতা রাব্বানী ও তাজিক নেতা রশীদ দোস্তামেরা জোট বেঁধে রাশিয়া ও ভারতের সাহায্যে উত্তরাঞ্চলে টিকে থাকে এবং মাযারী শরীফকে রাজধানী বানিয়ে তালেবান সরকারকে ব্রিত করতে থাকে। এক সময় তালেবানরা মাযারী শরীফও দখল করে নেয়। দেশের ৯৫ ভাগ তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে আসার পরও গণধিকৃত রাব্বানীদোস্তাম জোট ইসলামের চরম দুশমনদের পুতুল হিসেবে টিকে থাকে। আফগানিস্তানের উত্তরে পাশাপাশি সােভিয়েত রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তান ভাষা ও গােত্রীয় সম্পর্কের কারণে রাব্বানী-দোস্তাম জোটকে সাহায্য করতে থাকে। রাশিয়া ও ভারতের এত সহযােগিতা সত্ত্বেও এ জোট যা নর্দার্ন এলায়েন্স’ নামে এখন পরিচিত, তালেবান সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে কোনাে এলাকাই তাদের দখলে নিতে সক্ষম হয়নি। এখন ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর চাপিয়ে দেওয়া চরম অন্যায় যুদ্ধের সুযােগ নিয়ে আমেরিকার পুতুল সরকার কাবুলে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। রাব্বানীরা আফগানিস্তানে রাজত্ব করার যে স্বপ্ন দেখছে তা কি কখনাে জনগণের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হবে? 

তালেবান সরকারের মূল্যায়ন 

তালেবান সরকারের সামগ্রিক নেতৃত্ব দিয়েছেন মাদরাসায় পড়া ওলামায়ে কেরাম। তাদের ঈমান ও ইখলাস প্রশ্নাতীত। মােল্লা ওমর ও তার সাথীগণ নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে কাজ করেননি। সত্যিকার ইসলামী হুকুমাত কায়েম করার জন্যই তারা সরকার গঠন করেছিলেন। তাই তারা আল্লাহ তাআলার অলৌকিক সাহায্য ও জনগণের সক্রিয় সমর্থন পেয়েছিলেন। হেকমতিয়ার বাহিনীতে যেমন ইসলামপন্থি অনেক আধুনিক শিক্ষিত লােক ছিল, তালেবানদের মধ্যে যদি তা থাকত তাহলে মাদরাসা শিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষিতদের সমন্বয়ে আফগানিস্তানে একটি আধুনিক ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্র গড়ে তােলা সম্ভব হতাে। কারণ ঈমান ও ইখলাসের সাথে ইলম ও হিকমত অপরিহার্য। এদিক দিয়ে তালেবান সরকার পরিচালকদের মধ্যে হেকমতের অভাব ছিল বলে অনেকেই মনে করেন। 

গত শতাব্দীর শেষ দু'দশকের মধ্যে প্রথমে ইরানে, এরপর সুদানে এবং সর্বশেষে আফগানিস্তানে ইসলামী সরকার কায়েম হয়। ১৯৯৯ সালে লন্ডন ও নিউইয়র্কে বিশ্বের বেশ কয়টি দেশের ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাতের সুযােগে আমি প্রস্তাব রেখেছিলাম যে, বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের একটা ডেলিগেশন ঐ তিনটি দেশে সফর করা প্রয়ােজন। কারণ ইসলামকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কায়েম করতে গিয়ে তারা যদি সফল হন তাহলে যত দেশে ইকামাতে দীনের আন্দোলন সক্রিয়, সেসব দেশেও ইসলামী হুকুমাত কায়েম করার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। আর যদি তারা ইসলামকে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত করতে ব্যর্থ হন, তাহলে গােটা বিশ্বের সব দেশে ইসলামী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হবে। 

তাই এমন একটি ডেলিগেশন এসব দেশে গেলে জানা যাবে যে, তারা ইসলামী সমাজব্যবস্থা কায়েমের জন্য বাস্তবে এমন কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন যা যথার্থ এবং এমন কিছু করা হচ্ছে কিনা যার ফলে ইসলামের ভাবমূর্তি বিশ্বের দরবারে ক্ষুন্ন হতে পারে। এ ধরনের ডেলিগেশনকে তারা অবশ্যই গুরুত্ব দেবেন। তাদের সঠিক পদক্ষেপসমূহকে ডেলিগেশন বিশ্বময় প্রচার করলে তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে এবং তাদের ভুলটুকু দরদের সাথে ধরিয়ে দিলে তারা এর গুরুত্ব দেবেন। এটা করতে পারলে ডেলিগেশনের পরামর্শ ভবিষ্যতেও তারা চাইবেন।

দুঃখের বিষয় এ প্রস্তাবটিকে গুরুত্ব দেওয়া সত্ত্বেও এ কাজটি এখন পর্যন্ত করা সম্ভব হয়নি। এ বছর (২০০১) আগস্ট মাসে ইংল্যান্ডে আফগানিস্তানের প্রতিবেশী এক রাষ্ট্রের ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষনেতার সাথে সাক্ষাৎ হলে আফগানিস্তানের ইসলামী সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয় কি না জানতে চাইলাম। তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন যে, তারা পরামর্শকে গুরুত্ব দেন না। আমি বললাম যে, সকল নেতার একটা ডেলিগেশন গেলে অবশ্যই গুরুত্ব দেবেন। তিনি এ কথার সাথে একমত হলেন। ইতােমধ্যে তাে আফগানিস্তানে ইসলামী সরকার উৎখাতই হয়ে গেল।


ঐ তিনটি সরকারের মধ্যে ইরান ও সুদান এ দিক দিয়ে যতটুকু ভারসাম্য রক্ষা করে চলছে, তালেবান সরকার তা করতে পারেনি। না পারার প্রধান কারণ হলাে, হিকমাতের অভাব। দ্বিতীয় কারণ হলাে, রাব্বানী-দোস্তামদের সর্বাত্মক বিরােধিতা। সরকারকে সব সময় যুদ্ধাবস্থায় থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। তৃতীয় কারণ হলাে, তালেবান সরকার পাকিস্তান ও সৌদি আরবের স্বীকৃতি ছাড়া জাতিসংঘ ও বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাে, এমনকি মুসলিম দেশগুলােরও স্বীকৃতি পায়নি। ফলে সৌদি আরব এবং পাকিস্তানও বিরূপ হয়ে আমেরিকার হামলায় আপত্তি করেনি। তালেবান সরকার একঘরে হয়ে আন্তর্জাতিক মহা সন্ত্রাসের শিকারে পরিণত হলাে, আর ওআইসিসহ সকল মুসলিম দেশ নীরবে তামাশা দেখল। অবশ্য মুসলিম জনতা সকল গণতান্ত্রিক দেশে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।


আফগানিস্তানে ইসলামের ভবিষ্যৎ 

জাতিসংঘ ও ইঙ্গ-মার্কিন চক্র হয়তাে আশা করে যে, তাদের পুতুল সরকার সে দেশের জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে এবং তাদের নির্দেশ মতাে দেশ পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। প্রকৃত অবস্থা হলাে, তারা আফগানিস্তানে দীর্ঘকাল অশান্তি জিইয়ে রাখারই ব্যবস্থা করল। বৃহত্তর পাখতুন জনগােষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব যে সরকারে অনুপস্থিত, সে সরকার কী করে সফল হবে? তাদের পুতুল সরকার সে দেশে নির্বাচনের প্রহসনও করতে সাহস করবে কি? আফগানিস্তান এখন থেকে দিল্লি ও মস্কোর নির্দেশেই চলবে। আমেরিকা সেখানে খনিজ সম্পদ লুণ্ঠনের ব্যবস্থা করবে। 

এ পরিস্থিতি স্বাধীনতাপ্রিয় আফগান জনগণ কতদিন বরদাশত করবে? ইসলামী আন্দোলন জনগণের আস্থা হারায়নি। যথাসময়ে আবার ইসলামী শক্তি সংগঠিত হয়ে পুতুল সরকারকে রুখে দাঁড়াবে। সেখানে তুরস্ক ও আলজিরিয়ার মতাে সুসংগঠিত ধর্মনিরপেক্ষ সেনাবাহিনী নেই। 

রাব্বানীদের বাহিনী আগেও ব্যর্থ হয়েছে, আবারও হবে 

তালেবান সরকার দেশ গড়ার কাজ করার সুযােগ পায়নি। অন্যায়ভাবে আমেরিকার পরাশক্তি সে সরকারকে উৎখাত করেছে বলেই সে দেশের জনগণ নিজ চোখে দেখল। জনগণ তালেবানদের ব্যর্থ মনে করছে না। তাদের পূর্ণ সমর্থন এখনাে বহাল আছে। তাই আজ হােক কাল হােক এ আগুন এক দিন পুতুল সরকারকে উৎখাত করে ছাড়বে, ইনশাআল্লাহ। 

পাকিস্তানই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলাে 

আফগানিস্তানে এ ট্র্যাজেডির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলাে পাকিস্তান। আর সবচেয়ে বেশি লাভবান হলাে ভারত। পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর থেকেই আফগানিস্তানের বাদশাহ জহীর শাহ ভারতের পৃষ্ঠপােষকতায় সীমান্ত প্রদেশকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে পাখতুনিস্তান কায়েমের ষড়যন্ত্র করে। সীমান্ত গান্ধী নামে কুখ্যাত গাফফার খানের নেতৃত্বে পশতুভাষী পাঠানদের বিদ্রোহী বানানাের অপচেষ্টা চলে। রাশিয়া আফগানিস্তান দখল করে নজীবুল্লাহর পুতুল সরকার কায়েমের পর আফগানিস্তানের ইসলামপন্থি ছােট-বড় সাতটি দলকে পাকিস্তান সরকার সীমান্ত প্রদেশে আশ্রয় দেয়। পাকিস্তানের পৃষ্ঠপােষকায় তারা ১০ বছর জিহাদ করে রাশিয়াকে পরাজিত করে। এরপর থেকে কাবুলের প্রতিটি সরকার পাকিস্তানের পূর্ণ সমর্থন পেয়েছে, বিশেষ করে তালেবান সরকার পাকিস্তানের সাহায্যেই টিকেছিল। 

২৫ বছর পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার আফগানিস্তানের জন্য যে বিরাট কুরবানী দিল তা ভেস্তে গেল। এখন কাবুলে পাকিস্তানের চরম বৈরী এবং ভারতের পুতুল সরকার কায়েম হলাে। জেনারেল মােশাররফ আফগান ইস্যুতে পাকিস্তানের জনগণের আস্থা হারালেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে এর প্রভাব কতটুকু পড়বে তা দেখার বিষয়। উপমহাদেশে ভারতের শক্তি বৃদ্ধি পেল। কাশ্মীরে ভারত আরাে হিংস্র ভূমিকা পালনে উদ্বুদ্ধ হবে, এমনকি আযাদ কাশ্মীরেও ভারত সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে পারে। 


বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের ভাবনার বিষয় 

তালেবান সরকারের পতনের ফলে বিশ্ব ইসলামী আন্দোলন দু’দিক দিয়ে বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হলাে। একদিক হলাে এই যে, ইরান ও সুদানে ইসলামী সরকার কায়েম হওয়ায় বিশ্বের সর্বত্র ইসলামী আন্দোলন প্রেরণাবােধ করেছিল, তালেবান সরকারের পতনে ঐ প্রেরণা বিরাট এক ধাক্কা খেল। অপরদিকে মহিলাদের ব্যাপারে তালেবানদের পলিসিকে ব্যবহার করে বিশ্বের ইসলামবিরােধী মাস-মিডিয়া ইসলামকে নারী অধিকারবিরােধী হিসেবে প্রােপাগান্ডা করার বিরাট সুযােগ পেয়ে গেল। তালেবানরা ইসলামী শাসনের যেটুকু সুফল জনগণকে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন, তা বিশ্ববাসী জানতেই পারল না। ফলে নতুন করে কোনাে দেশে ইসলামী সরকার কায়েমের আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হলাে। 


বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে এ ক্ষতিপূরণের উদ্দেশ্যে ইরান ও সুদানকে আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য সর্বাত্মক সহযােগিতা করা প্রয়ােজন, যাতে তালেবান সরকারকে ইসলামের প্রতিনিধি দেখিয়ে ইসলামকে হেয় করার সুযােগ যারা নিচ্ছে তাদের হামলা থেকে সত্যিকার ইসলামকে রক্ষা করা যায় । 

তা ছাড়া গণতান্ত্রিক যেসব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে সরকার পরিবর্তনের সুযােগ রয়েছে, সেসব দেশের ইসলামী আন্দোলন যাতে ক্ষমতাসীন হতে পারে, সে উদ্দেশ্যে বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনকে সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। 

আরাে কয়েকটি দেশে ইসলামী সরকার কায়েম হলে তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিশ্বের দরবারে ইসলামের সত্যিকার কল্যাণময় রূপ বাস্তবে তুলে ধরা সহজ হবে। খােলাফায়ে রাশেদীনের যুগে ইসলামের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা মানবজাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হওয়ায় পারস্য ও রােম সাম্রাজ্যও ইসলামী সভ্যতার অগ্রগতি রােধ করতে পারেনি। পাশ্চাত্যের জড়বাদী সভ্যতা আবারও ইসলামের মানবিক ও নৈতিক সভ্যতার নিকট পরাজিত হতে পারে, যদি ইসলামের আসল রূপ বাস্তবে কায়েম করে দেখানাে যায়।


[জীবনে যা দেখলাম -অধ্যাপক গোলাম আযম/ খণ্ড:৫/ পৃ: ৩১৯-৩২৮]